
নিঝুমনিদ্রা ভেঙে জেগে দেখি সবখানে এক অপরূপ আঁধার ; আমার ধূপ-ধোয়া ঘরে প্রবেশ করছে হাওয়া-মাতাল বৃষ্টিজলের ছাঁট । গরাদে ঝুলে আছে – জলমগ্ন রাত , বাবার খয়েরি শার্ট , বিমর্শ রোদ-চশমা । আনত ফ্রেম থেকে উড়ে যাচ্ছে তেরটি স্মৃতির পাখি , উদ্দেশ্যহীন । এইসব হিমশীতল নৈঃশব্দ্যের রাতে আশ্চর্য এক নিঃসঙ্গতা বুকে চেপে বসে । কখনো মনে হয় বৃষ্টি এক নির্জন উপত্যকার ডাকনাম , এই ভেবে ক্রমশ অস্থির হয়ে পরি । বাইরে থেকে হয়তো নিমজ্জিত আলোরা ঘরে এসে পরে , সেই আলো আঙ্গুলে জড়িয়ে আরও ব্যথিত হই , ছায়া-মগ্ন হয়ে থাকি । অন্ধকারে বিছিয়ে দেই মায়াবী ক্যানভাস ; দেখি উড়তে উড়তে তেরটি স্মৃতির পাখি হারিয়ে যাচ্ছে অনিঃশেষ প্রান্তরে । ক্যানভাসে ক্রমশ ফুটে উঠছে বাবার বিষণ্ণ মুখ , মায়ের ব্যথিত দৃষ্টি !
বেনুদিকে মনে পরে , মনে পরে বেনুদির হাসি । বেনুদির শাড়ী উড়ে গ্যাছে হাওয়ায় । সে শাড়ী থেকে জন্ম নিলো পাঁচটি গোপন নদী । একটি নদী আমার ; আমার নদীর নাম সিথিসিদুর । বেনুদি আমার চার ক্লাস উপরে পড়েন ; বেনুদি থাকেন আমাদের পাশের গ্রামে । বেনুদি সারাদিন নদী তীরে ঘুরে বেড়ান , আর আমি তার পিছু পিছু হাটি । বেনুদি কবিতা ভালোবাসেন , হাটতে হাটতে কবিতা আওড়ান –
জল-শিথিল গাঙ ;
সে গাঙ্গে মাছরাঙাটি থাকে –
মাছরাঙ্গাটি ধরতে গিয়ে হারাই নদীর বাঁকে !
- ও দিদি ! তোমার তো অনেক নদী । একটা নদী দাওনা ?
- নিবি ? যা তোকে একটা নদী দিয়ে দিলাম !
- আমার নদীর নাম কি ?
- তোর নদীর নাম দিলাম সিথিসিদুর !
সেই থেকে আমি সিথিসিদুর নদীর বাঁকে থাকি । প্রতিদিন একটি দুঃখ ফেলে দেই জলে । কুড়িয়ে নেই অজস্র শঙ্খ ; কেননা –
বেনুদির দৃষ্টি জুড়ে শঙ্খ নদীর গান , এলোচুলে নেমে এলো গভীর বৃষ্টিবান......
বাবা কবিতা লিখতেন , আর সে কবিতা উড়িয়ে দিতেন হাওয়ায় । উড়তে উড়তে সেগুলো পেরিয়ে যেত কল্লোলিত কাশবন , বিচ্ছিন্ন রেললাইন , বেনুদিদের সাঁঝ উঠোন । আমি সে কবিতা মুঠোয় পুরে বেনুদিদের বাড়িতে ছুটতাম – “ অন্ধকার নিকটে এলে ঘাস-ফুল তুমি কোথায় লুকাও ? করতলে রেখেছি ঘ্রানলিপি , ধ্রুপদী সুর । সমুদ্র-স্নানের পর ব্যথিত পাখিরা ঘরে ফিরে , ঠোটে করে নিয়ে আসে অরন্যসবুজ । চুপি চুপি আমি কেন সেই অরণ্যে হারাই ? ...... ” । আমরা কবিতা পড়তাম , আর হাসতাম । হাসতে হাসতে আমাদের চোখে জল আসত , সেই জল আঙ্গুলে নিয়ে বেনুদি একটি শূন্য চিহ্ন এঁকে দিতেন কবিতা পৃষ্ঠায় ।
বাবা কবিতাপৃষ্ঠায় একটি জল-অংকিত অদৃশ্য শূন্য চিহ্ন দেখে বিষণ্ণ হয়ে যেতেন ; তার কপালের ভাঁজে ঝুলে পরত বিষণ্ণ শব্দাবলী । তার কোন কবিতার বই নেই , তার কবিতা কেউ ছাপে না । কেবল মা কবিতাগুলো সস্নেহে সাজিয়ে রাখতেন গোপন দেরাজে । মাঝে মাঝে বের করে পড়তেন । তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত , গভীর থেকে বেরিয়ে আসত দীর্ঘশ্বাস । মা বাবাকে গভীর ভালোবাসেন । অথচ আমি বুঝতে পারি কোন এক বিচিত্র কারণে বাবা , মাকে ভালবাসেন না ।
এক শীতের সকালে বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন , তার হাতের মুঠোয় অজস্র বকুল কুড়ি ! বলেন –
- চল পাখিশিকারে যাই !
আমি বাবার হাত ধরে পাখি শিকারে চলি ; আমাদের গ্রামের কোণে এক অন্ধ অরণ্য আছে , কেউ জানেনা । সে অরণ্য আমার এবং তাতে অনেকগুলো সারস উড়ে বেড়ায় ! আমি সারস ভালবাসি ; কেননা মাঝে মাঝে খুব উড়তে ইচ্ছে করে । আমার পকেট-ভর্তি সারসের পালক , মুঠোভরতি ডানা ! আমি উড়তে পারিনা ,
- বাবা , আমি উড়ব !
- উড়বি ? চল উড়ি !
বাবা আমাকে কাঁধে তুলে নেন । আমি উড়তে উড়তে পেরিয়ে যাই কুয়াশা , অজস্র শস্য-জমিন , একটি নদীসাকো ! শূন্যে উড়িয়ে দেই পালক – ডানা , অনির্দিষ্টে ।
বাবা নদীতীরে পাখি-ফাঁদ পাতেন , আর আমি কাশফুল-বনে অপেক্ষা করি ! কিছু কাশফুল ছিঁড়ে লুকিয়ে রাখি বুকে , গলায় পরে নেই পুষ্পমাল্য । কাশফুল এবং উজ্জ্বল দুপুর ক্রমশ ডুবে যায় নদীজলে , সুদূরে দেখি – বেনুদির ছায়া , হেঁটে আসছেন নদীতীর ধরে । আমি ডাকি
- ও বেনুদি ! ......
বেনুদি কেবল হাসেন , বলেন – কিরে ! কাশবনে হারালি কবে ?
- হারাই নি , ফুল তুলি ! হি ...হি...
বেনুদি কাশবনে আসেন , কিছু ফুল উড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে যান ।
বাবা ফাঁদ পেতে ফিরে এসে বলেন
- ওটা কেরে ?
- ওর নাম বেনুদি । বেনুদি তোমার কবিতা খুব পছন্দ করে ।
বাবার মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয় , বাবার দিকে তাকিয়ে বেনুদি লজ্জা পেয়ে চলে যান ।
- চল ! আজকে আর পাখি ধরব না , ফিরে যাই !
আমি আশ্চর্য হয়ে ফিরে আসি , পাখিশুন্য আমাদের দেখে মা কিছুটা হতাশ হন !
তারপর চলে এলো আরেকটি বসন্ত , আমাদের বয়স বেড়ে যায় হঠাত । দেখি – সবখানে এক অদৃশ্য পরিবর্তন । মা এবং বাবার মাঝে ক্রমশ বেড়ে চলেছে দূরত্ব , গড়ে উঠছে প্রস্তর-দেয়াল । মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন , আমি ব্যথিত হই । আমি এখন প্রতিদিন স্কুলে যাই , আমার রোল – এক । আমি ছবি আঁকি , মাঝে মাঝে সে ছবি ছাপা হয় পত্রিকায় । মা সে ছবি ঘরের দেয়ালে টানিয়ে দিয়ে হাসেন । তার হাসির অভ্যন্তরে দেখতে পাই অনন্ত বেদনা ।
বাবা এখন মাকে কবিতা পড়ে শোনান না , আমাকে দিয়ে বলেন
- তোর বেনুদিকে কবিতাটা দিয়ে আয় !
আমি কবিতা দিতে এসে দেখি বেনুদির পরিবর্তন , বেনুদি এখন আর হাসেন না , কেমন লজ্জিত হয়ে কবিতা পড়েন নিশ্চুপ ! তারপর একটা চিঠি আমাকে দিয়ে বলেন
- এটা তোর বাবাকে দিবি । তুই পড়িসনা , বল তিন সত্যি !
আমি তিন সত্যি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি , উঠোন পেরিয়েই খুলি চিঠি-ভাজ ! পড়তে পড়তে আমি লজ্জিত হই , বুঝতে পারি বেনুদি বাবাকে ভালোবাসেন । তারপর সে চিঠি ফেলে দেই সিথিসিদুর নদীর জলে , একটি দুঃখসহ ! বাবা মাঝে মাঝে বলেন
- একদিন ওই কাশফুল-বনে হারিয়ে যাব , দেখিস ...
আমার বিশ্বাস হয়না , কেননা বাবাকে আমি ভালোবাসি । স্কুলে আমার কোন বন্ধু নেই , আমি নিঃসঙ্গ । আমাকে কেউ পছন্দ করেনা । ছুটি হলে কেউ আমাকে খেলায় নেয় না । আমি কষ্ট পাই এবং ছবি আঁকি । আমার কোন রং-পেন্সিল নেই , আমার কোন ক্যানভাস নেই ! আমি ছবি আঁকি আমার স্কেচ-খাতায় , কলম দিয়ে । সবাই সে ছবি দেখে হাসে ,আমি বাবার মত সে ছবি উড়িয়ে দেই হাওয়ায় ।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনি – মা কাঁদছেন । আমি দেখি আমাদের ঘরের সামনে অজস্র লোকের ভিড় । আমি নিকটে যেতেই মা আমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন, আমি বিস্মিত হই । আমার চোখে জল আসে , কেউ একজন এসে সেই জল মুছিয়ে দিয়ে চলে যায় ।
আমি বুঝি আমি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গাছি । আমি বুঝি - বাবা বেনুদিকে নিয়ে হারিয়ে গ্যাছেন কাশফুল-বনে , বেনুদি খুঁজে পেয়েছে তার হারানো নদী ।
আমি সিঁথি সিঁদুর নদীর জলে কাগজের নৌকোসহ এই দুঃখটা ভাসিয়ে দিলাম এবং একটি ধুসর ছবি এঁকে , হাওয়ায় টাঙিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম ...
***